তাহের আহমদ:আজ ১৭ রমজান, পবিত্র ঐতিহাসিক বদর দিবস। এ দিনে সংঘটিত বদর প্রান্তরের যুদ্ধ ছিল ইসলামের প্রথম সিদ্ধান্তমূলক সামরিক জেহাদ। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রজমান বদর প্রান্তরে এ ঐতিহাসিক জেহাদ সংঘটিত হয়ে মুসলমানদের বিজয় রচিত হয়েছিল।
বদরযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পবিত্র মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে ইসলাম তথা মুসলমানদের বিজয়ের ধারা সূচিত হয়েছিল এবং পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে আবু জেহেলের ১০০০ সুসজ্জিত বাহিনীর বিপরীতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ৩১৩ জন সাহাবায়েকেরাম সাধারণ অস্ত্র নিয়ে আল্লাহ তায়ালার গায়েবী সাহায্যে আবু জেহেলের বিশাল বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেছিলেন অত্যন্ত কঠিনভাবে।
এ যুদ্ধে মুশরিক বাহিনীর ২৪ জন সর্দারের লাশ একটি নোংরা কুয়ায় নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এ যুদ্ধে ২ জন আনসার কিশোর সহোদর হযরত মায়াজ (রা.) ও হযরত মোয়াজ (রা.) আবু জেহেলকে হত্যা করে। সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) আবু জেহেলের মাথা কেটে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে হাজির করেছিলেন।
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর ১৪ জন শহীদ হয়েছিলেন, আর মুশরিক বাহিনীর ৭০ জন নিহত এবং ৭০ জন বন্দী হয়েছিলেন। আর এরা ছিল গোত্রসমূহের সর্দার এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। এ জেহাদে ইসলাম ও রাসূল (সা.)-এর চরম ১৪ জন শত্রুর মধ্যে আবু জেহেল, উৎবা ও শায়বাসহ ১১ জনই জাহান্নামে পৌঁছে যায়। যুদ্ধ শেষে বদর প্রান্তরে নিয়ম অনুয়ায়ী ৩ দিন অবস্থান শেষে চতুর্থ দিনে রাসূল (সা.) মদিনার পথে যাত্রা করলেন। এ সময় তার সাথে ছিল বন্দী কোরায়েশগণ এবং গনিমতের মালামাল। আর এসবের তত্ত্বাবধানে ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে কা’ব (রা.)। রাসূল (সা.) ছাফরা প্রান্তরে কাফের বাহিনীর পতাকা বহনকারী নযর ইবনে হারেশকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যেসব পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কারণে বদরযুদ্ধের সূচনা হয় তা হচ্ছে মদীনা শরীফে সাফল্যজনকভাবে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কুরাইশদের হিংসা, আবদুল্লাহ বিন ওবাইর ও ইহুদীদের ষড়যন্ত্র, সন্ধি শর্ত ভঙ্গ, কুরাইশদের যুদ্ধের হুমকি, বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা, কাফেরদের দ্বাড়া আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা, ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তির ধ্বংস সাধন এবং নবীজী (সা.) কে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার অশুভ চক্রান্ত। এর প্রত্যক্ষ কারণ ছিল নাখলার ঘটনা, কাফেরদের রণপ্রস্তুতি, আবু সুফিয়ানের অপপ্রচার, যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য ওহী লাভ, মক্কাবাসীদের ক্ষোভ। এসব কারণ এবং আবু জেহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্য নিয়ে মদীনা আক্রমণের সংবাদ শুনে তাদের গতিরোধ করার জন্য ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ রমজান তারিখে ৩১৩ জন মুজাহিদ (৬০ জন মুহাজির অবশিষ্টরা আনছার) নিয়ে মদীনা শরীফের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ৮০ মাইল দূরে বদর নামক স্থানে যুদ্ধে উপনীত হন এবং ১৭ রমজান রক্তক্ষয়ী বদর জেহাদ সংঘটিত হয়।
বদর যুদ্ধের সফলতা ছিল আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি, বিশ্ববিজয়ের সূচনা, সর্বোত্তম ইতিহাস সৃষ্টি, প্রথম সামরিক বিজয়, কুরাইশদের শক্তি খর্ব, ইসলামী রাষ্ট্রের পত্তন, নবযুগের সূচনা, রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি স্থাপন, জেহাদের অনুপ্রেরণা, বীরত্বের খেতাব লাভ, পার্থিব শক্তির ভিত্তি স্থাপন, ইসলাম ও মহানবী (রা.)-এর প্রতিষ্ঠা, মিথ্যার ওপর সত্যের জয় সত্য-মিথ্যার পার্থক্য সৃষ্টি সূরা আনফালে ঘোষিত আল্লাহ তায়ালার ওয়াদা পূরণ, দয়াল রাসূল (সা.) উনার দোয়া কবুল এবং বদর জেহাদে মুসলমানদের পক্ষে আল্লাহ তায়ালার গায়েবী সাহায্যের জলন্ত প্রমাণ। বদর জেহাদের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হচ্ছে বদর জেহাদে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণের মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ের সাহাবীগণের মধ্য থেকে নেতৃত্বদানকারী ছিলেন হযরত ওমর (রা.), হযরত আলী (রা.) ও হযরত আমীর হামযা (রা.)।
কাফেরদের মধ্যে নেতৃত্বে ছিলেন আবু জাহেল, উৎবা, শায়বা ও পতাকাবাহী নযর ইবনে হারেশ, ওয়ালিদ বিন মুগিরা আবু সুফিয়ান।
সাহাবাগনের (রা) পক্ষ থেকে প্রথম তীর নিক্ষেপকারী সাহাবী ছিলেন হযরত সা’দ ইবনে ওয়াক্কাস (রা.)। বদর জেহাদে অংশ নেয়া সাহাবী (রা.) মধ্যে ২ জন ছিলেন উষ্ট্রারোহী ৮০ জন তলোয়ারধারী এবং অবশিষ্টগণ হচ্ছে তীর বা বর্শাধারী। এ জেহাদে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের দিয়ে সাহায্য প্রদান করেন। এ জেহাদের পূর্বরাতে কাফেরদের কোন কোন নেতা কোন কোন স্থানে নিহত হবেন রাসূল (দ.) উনার গায়েব নামক মোজেজা। জেহাদের পূর্বরাতে বদর প্রান্তরে প্রবল বৃষ্টির কারণে কাফেরদের এলাকা কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল হয়ে পড়া। সাহাবগনের বালুময় অবস্থান স্থল বৃষ্টির কারণে জমে গিয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া এবং পানি সংগ্রহের সুযোগ পাওয়া। গায়েবীভাবে খেজুরের ডাল তলোয়ারের মতো ধারালো হওয়ায় তা দ্বারা কাফেররা কতল হওয়া।
রমজান মাসেই হযরত রাসূলুল্লাহ (স.) তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করে ইসলামকে বিজয়ী করেছিলেন। এ যুদ্ধেই প্রমাণ হয় ‘রাজনীতি বিবর্জিত ধর্ম আর জিহাদ বিবর্জিত রাজনীতি পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না।