২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটে যাওয়া একটি হত্যাকাণ্ডের রায় হয়েছে রোববার। যেই হত্যাকাণ্ডটির দৃশ্যায়ন আমরা দেখেছি টিভি চ্যানেলে, বিশদ বিবরণ পড়েছি পত্রিকায়। আছে ফুটেজ, আছে স্থিরচিত্র। তবুও আমরা এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণকারী কাউকে কাউকে খালাস পেতে দেখলাম, কারো মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন পেতে দেখলাম।
আমি আইনের ছাত্র নই, আইনের মারপ্যাঁচও বুঝি না। আর তাছাড়া আছে আদালত অবমাননার আশঙ্কা। তাই এই রায়ের ব্যবচ্ছেদ আমি করব না, পারবও না। নিশ্চয়ই উপযুক্ত প্রমাণের অভাবেই রায়টি এমন হয়েছে। রায়ের বিবরণীতে বিচারকদেরও একই আক্ষেপ করতে দেখলাম। বিশেষ করে, সুরতহাল আর ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনকে ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আমি শুধু এই দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এই রায়ে আমাদের মনে বিচার ব্যবস্থা নিয়ে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে এর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে/পড়বে সেটুকুর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
বিশ্বজিতের পরিবারের সাথে একাত্ম হয়ে আমরাও অনুভব করছি, বিশ্বজিতের পরিবার ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হলো। আদালতের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের শাস্তি কমে যাওয়াতে এবং কেউ কেউ বেকসুর খালাস পাওয়াতে আমরা যারপরনাই হতাশ এবং ক্ষুব্ধ হয়েছি। বিশেষ করে রায়ের বিবরণীতে যখন পড়লাম যে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওচিত্র ও স্থিরচিত্র আমলে নিয়েই বিচারকাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। আমরা বুঝতে পারিনি সেই ভিডিও ও স্থিরচিত্রগুলোর কোন দিকটা আমলে নেয়া হয়েছে? যেখানে সারা দেশের মানুষ দেখেছে অন্তত ১০-১২ জন ছেলে বিশ্বজিতকে কুপিয়েছিল, হত্যার সাথে জড়িত ছিল। শুধুমাত্র সুরতহাল রিপোর্ট আর ময়নাতদন্তের রিপোর্টই কি সব? ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আর কিছুই কি করার নেই?
এই তো আমার সেই দেশ, যেই দেশে বিশ্ব মোড়লদের শত চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে এবং দেশি বিদেশি পেইড এজেন্টদের ষড়যন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাঘববোয়াল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সম্ভব। সেই একই দেশে প্রকাশ্য দিবালোকে অসংখ্য মানুষের চোখের সামনে কুপিয়ে হত্যা করা বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া কেন সম্ভব হয় না? ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা কি এতই কঠিন? ন্যায় বিচারের চোখ কি সত্যি সত্যিই জাস্টিসিয়ার মতো কালো কাপড় বাঁধা থাকে? আমি মেলাতে পারি না।
বর্তমান বাংলাদেশে অপরাধচিত্র ভয়াবহ। নৈতিকতার চরম অবক্ষয় চলছে চারদিকে। প্রতিদিন ধর্ষিত হচ্ছে নারীরা, শিশুরা। জঙ্গিবাদের ফাঁদে পা দিচ্ছে আমাদের তরুণেরা। এইসব অপরাধের লাগাম ধরতে এবং নৈতিক অবক্ষয় ঠেকাতে অনেককিছু করা দরকার আমাদের। কিন্তু সবার আগে দরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। যে সমাজে, রাষ্ট্রে অপরাধের সঠিক বিচার হয় না, অপরাধী বিনা বিচারে ছাড়া পেয়ে যায়, কিংবা লঘু দণ্ডে দণ্ডিত হয়, সেই সমাজে অপরাধ প্রবণতা বাড়বে সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?
বিশ্বজিতরা রাঘববোয়াল নয়, বিশ্বজিতরা এমনিতেই মুখ গুঁজে বাঁচে। বিশ্বজিতের রক্তে আমি আমার সন্তানের রক্ত দেখতে পাই। বুকের ভেতর কাঁটা হয়ে বিঁধে থাকে সন্তান হারানোর হাহাকার, ভাই হারানোর কান্না। বিশ্বজিতের রক্তে আমি সিঁড়ির উপর রক্তাক্ত বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পাই, মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা শেখ কামালকে দেখতে পাই, ছোট্ট রাসেলকে দেখতে পাই। দেখতে পাই বছরের পর বছর পিতৃহত্যার, ভাতৃহত্যার বিচার না পাওয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও।
আমরা চাই, ন্যায়বিচারের পথে প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত হোক এবং প্রতিকারের যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হোক। নইলে বিচার বিভাগের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা যে তলানিতে এসে ঠেকেছে, সেটা কিছুদিন পর বিলীন হয়ে যাবে সম্ভবত।
আমরা সেই ক্ষত বাড়তে দেবো কিনা, নাকি সারিয়ে তোলার চেষ্টা করবো, সেটা ভাবতে হবে এখনই। বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের।
শাশ্বতী বিপ্লব, কবি