নিউজ ডেস্ক: বেগুনি শাপলা দেখেছেন? এমন প্রশ্নে চমকে উঠলাম! শহুরে মানুষরা সাদা কিংবা লাল শাপলা ছাড়া অন্য কোন রঙের শাপলা চিন্তা করতে পারে না। রাতেই ঢাকা থেকে মাত্র ২৩০ কিমি দূরে রওয়ানা হলাম। কাকডাকা ভোরে পথে দু’ধারে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্যমণ্ডিত সারি সারি চা বাগান আমাদের স্বাগত জানালো।
শ্রীমঙ্গল নেমে সিএনজিযোগে রওয়ানা দিলাম। পথে পড়লো চা বোর্ড, চা গবেষণা কেন্দ্র, চা জাদুঘর, লাউয়াছড়া উদ্দ্যান, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা আর মুনিপুরি পাড়া। অনেকটা ঘোরের মধ্যেই এসে পৌছালাম মাধবপুর টি এস্টেটের গেটে। দু’ধারের চা বাগানের ছবি তুলতে তুলতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। দেরি হচ্ছে দেখে সঙ্গীরা তাড়া দিল।
বড়সড় একটা ধাক্কা অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। হ্রদের পাড়ে পৌঁছে আমরা হতবাক! মেঠোপথ দিয়ে একটু উঁচুতে উঠতেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল আমাদের। কোথায় এলাম? এতো সুন্দর! চারদিকে অজস্র ছোট-বড় টিলার মধ্যে দিয়ে নয়নাভিরাম হ্রদ। মনে হচ্ছিল শিল্পীর হাতে আঁকা ছবি ক্যানভাস দেখছি।
মাধবপুর হ্রদ এই চা বাগানের সম্পত্তি, তাই তাদের তত্ত্বাবধানে এই হ্রদ। প্রায় পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত এই হ্রদ। চা-বাগানের মেঠোপথে হাঁটার সময় চোখে পড়ল নানা বনৌষধি গাছ। আমলকী, হরীতকী, বহেরা কী নেই?
দেখলাম চাগাছের নার্সারিও। স্থানীয়দের কাছে এটিকে ‘ড্যাম’। কালক্রমে এটি বৃহৎ ও আকর্ষণীয় ড্যামে পরিণত হয়েছে। পাহাড়ি উঁচু-নিচু টিলার মাঝে প্রায় তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে পানির ড্যাম বা হ্রদের আয়তন ৫০ একর। পাহাড়ি টিলা স্পর্শ করে এঁকেবেঁকে যাওয়া ড্যামের চারপাশে উঁচু পাহাড়ি টিলা, চা বাগানের সবুজ বৃক্ষরাজি, দুর্লভ নীলপদ্ম বা বেগুনি-শাপলা, রঙবেরঙের জলজ ফুল শোভা বাড়িয়েছে।
টলটলে পানিতে সাদা শাপলা, লাল শাপলার দেখলাম। অবশেষে দেখা মিলল বেগুনী শাপলার। একশ, দুশ, তিনশ… সহস্র! আরও জানলাম হলুদ বর্ণেরও শাপলা দেখা মিলে কোন কোন সময়। মাঝে হ্রদ আর চারদিকে টিলার ঢালে সারি সারি চা বাগান। হ্রদের ধারে পায়ে হাঁটা পথ ধরে মিলবে অভাবনীয় দৃশ্য। প্রতিবছর এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পিকনিকে আসে। টিলার চূড়ায় উঠে হ্রদের দৃশ্য দেখার মজায় আলাদা। এবার টিলায় ওঠার পালা। হ্রদ দর্শন হবে উঁচু থেকে।
চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পৌঁছালাম সবচেয়ে উঁচু টিলার ওপর। টিলার ওপর আছে বসার জায়গা। উঁচু থেকে হ্রদ দর্শনের লোভ কেউ সামলাতে পারে না। সবুজ ঘন চা বাগান ও টিলাগুলোর পাশ দিয়ে হ্রদ এঁকেবেঁকে গেছে। দুপুরের নরম রোদের আলো আছড়ে পড়ছে চারদিকের টিলায়। আর তার ছায়া পড়েছে হ্রদের ফটিকসদৃশ হ্রদের পানিতে। সে এক মনমুগ্ধকর দৃশ্য। পাহাড়ের ওপর উঠে যখন হ্রদের দিকে তাকালাম, মুহূর্তেই সারারাতের ভ্রমণের ক্লান্তি উধাও।
মাধবপুর হ্রদের স্বচ্ছ পানি, শাপলা শালুক, গা ঘেঁষে থাকা চা বাগানের টিলার বানর, হনুমানের প্রকাশ্য বিচরণ পর্যটকদের আনন্দ বাড়িয়ে দেয়। শীতে হাজার হাজার অতিথি পাখিরও সমাগম ঘটে। হ্রদে অনেকে বড়শি দিয়ে মাছও শিকার করেন। নিরাপত্তা এবং রাত্রিযাপনের নেই কোন ব্যবস্থা।
মাধবপুর হ্রদ থেকে বেরিয়ে সীমান্তঘেষা বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ ও দলাই বিজিবি সীমান্ত ফাঁড়ি দেখে যেতে পারেন। এ স্মৃতিসৌধের কাছেই মুক্তিযুদ্ধে অক্টোবর মাসের শেষের দিকে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের শাহাদৎ বরণ করেছিলেন। পথে যেতে পড়বে চা বাগানের নয়নাভিরাম দৃশ্য আর বেশক’টি চা কারখানা। যদিও কারখানাগুলোতে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। দিগন্তের যেদিকে তাকান শুধু পাহাড়ী চা বাগান। চা বাগানের মধ্যে স্মৃতিসৌধটি ছোট্টখাটো, কিন্তু চিত্রাকর্ষক। পাশেই দলাই বিজিবি সীমান্ত ফাড়ী আর সিকি কিমি দূরে ভারতীয় সীমানা। এখানে এলেই যে কারো মন ভালো হয়ে যাবে বৈকি।
ফিরে যাওয়ার পথে সবশেষে ঢুঁ মারতে পারেন মুনিপুরী ললিতকলা একাডেমীতে। মুনিপুরীদের সংস্কৃতি আর কৃষ্টি-কালচার সম্পর্কে জানতে ভুলবেন না।
যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল যেতে পারেন ট্রেনে। পারাবত, জয়ন্তিকা অথবা উপবনে। ঢাকা থেকে সায়েদাবাদ বা মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে মৌলভীবাজারের গাড়ীতে শ্রীমঙ্গল বাসস্ট্যান্ড নেমে সিএনজি রিজার্ভ করে সোজা মাধবপুর লেকে যেতে পারেন। ৩৫০-৪০০ টাকা নিতে পারে। প্রবেশ পথে কোন এন্টি ফি নেই। শেয়ারেও যেতে পারেন। শ্রীমঙ্গল বাসস্ট্যান্ড থেকে কমলগঞ্জ সিএনজিস্ট্যান্ডে যেতে হবে। সেখান থেকে কমলগঞ্জ উপজেলা যেতে ভানুগাছ বাজারে নামতে হবে। ভাড়া মাথাপিছু ৩০ টাকা। সেখান থেকে পত্রখোলা যেতে মাধবপুর বাজারে নামতে হবে। ভাড়া ১০-১৫ টাকা। এরপর সামান্য হাটাপথে চা বাগান। মাধবপুর টি-এস্টেটের আশপাশে রেস্টুরেন্ট নেই। তাই আপনাকে কষ্ট করে তিন কিলোমিটার দূরে ভানুগাছে যেতে হবে খাওয়ার জন্য। তবে ভানুগাছ বাজারে নেমে দুপুরের খাবার নিতে পারেন। গ্রামের বাড়ি রেস্তোঁরা, রাঁধুনী রেস্তোঁরা, আল আকাবা রেস্তোঁরায় সস্তায় সুস্বাদু খাবার মিলে। ইচ্ছে করলে রাতে থাকতে পারেন হলিডে গেস্ট হাউজ কিংবা গ্রামের বাড়ি আবাসিক হোটেলে। মৌলভীবাজার শহরেও হোটলে ওয়েস্টার্ণে থাকতে পারেন। মাধবপুর বাজার থেকে পত্রখোলা বাজার হয়ে সীমান্তঘেষা বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ ও দলাই বিজিবি সীমান্ত ফাড়ী। ভানুগাছ বাজার থেকে সিএনজি রিজার্ভ করে মাধবকুন্ডু যেতে পারেন। ভাড়া পরবে ৩৫০-৪০০ টাকা।