এসবিএন ডেস্ক:
একজন শচীন টেন্ডুলকার তো অন্যজন রাহুল দ্রাবিড়! পরিচয়ে তাঁরা আসলে বাংলাদেশের মাশরাফি বিন মর্তুজা ও মাহমুদ উল্লাহ। দুই দেশের এ চার ক্রিকেটারের রান-উইকেটের যোগসূত্রও খোঁজা হচ্ছে না। এ চারের অন্ত্যমিলটা জনপ্রিয়তায়। টেন্ডুলকারের মতো জনপ্রিয়তা পিছু নিয়েছে মাশরাফির। আর নক্ষত্ররাজিতে কেমন যেন মিটমিটে তারা মাহমুদ উল্লাহ, ভারতীয় ক্রিকেট গ্রহে যেমনটা দ্রাবিড়। আজকের ফাইনালের ফল যা-ই হোক, খ্যাতির জগতে দুই অধিনায়কের পালাবদলের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
পালাবদল হলে তো ২০১৫ বিশ্বকাপের পরই হয়ে যেত। বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বকাপে প্রথম সেঞ্চুরি, তাও টানা দুই ম্যাচে এ কীর্তি গড়েও বিজ্ঞাপনের বাজারে মাহমুদ উল্লাহ ‘দুর্লভ’ নন মোটেও। ও রকম কীর্তি তামিম ইকবাল কিংবা সাকিব আল হাসানদের কেউ গড়লে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের মধ্যে। ২০০১ সালে কলকাতায় ফলোঅনে পড়েও ভারতের অভাবিত জয়ের স্মৃতিতে যেমনটা রাহুল দ্রাবিড়ের চেয়ে অনেক বেশি জ্বলজ্বলে ভি ভি এস লক্ষ্মণের ইনিংসটি। মাহমুদ উল্লাহর অবশ্য এ নিয়ে কোনো অনুযোগ নেই, ‘আমি মোটেও তারকা ক্রিকেটার নই।’
মাশরাফির বেলায় আবার উল্টোটা। শচীন টেন্ডুলকারের ‘টেনিস এলবো’ আর মাশরাফির হাঁটু নিয়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের চিন্তাটা সর্বজনীন। ম্যাচপূর্ব আলোচনাজুড়ে থাকত টেন্ডুলকার খেলতে পারবেন তো? বিপিএলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের ম্যাচের আগে প্রধান আলোচনাও একটাই—মাশরাফি বোলিং করবেন তো? টেন্ডুলকারের সংবাদ সম্মেলনে সংবাদকর্মীরাও যেন তাঁর অনুরক্ত। ভিক্টোরিয়ানসের আনুষ্ঠানিক প্রতিটি সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত মাশরাফির জন্যও বরাদ্দ অসীম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। প্রসঙ্গক্রমে বিষয়টি তুলে ধরলে মাশরাফি হাসেন কৃতজ্ঞচিত্তে, ‘এসব দেখলে দায়িত্বটা আরো বেড়ে যায়।’
অথচ ৮ ইনিংস বোলিং করে মাশরাফি উইকেট নিয়েছেন মোটে ৪টি। ব্যাটিংয়ে একটি ফিফটিসহ মোট রান ১০২। সেখানে উইকেট মোটে ৩টি হলেও দুটি ফিফটিতে ২৩১ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকার ৫ নম্বরে আছেন মাহমুদ উল্লাহ। কিন্তু স্ট্যাটাস দেখে কে বলবে, মাঠের নৈপুণ্যে বিপিএলে মাশরাফির চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন মাহমুদ উল্লাহ!
কিন্তু ক্রিকেট পরিসংখ্যানকে যেমন গুরুত্ব দেয়, তেমনি ‘গাধা’ বলে অবহেলাও করে। বিপিএলে মাশরাফি আর মাহমুদ উল্লাহর তুলনার বেলায়ও পরিসংখ্যানের খুব একটা মর্যাদা নেই। খোঁড়া পায়েও প্রয়োজনে ব্যাটিং-বোলিং আর অধিনায়কত্বগুণে মাশরাফি দলকে তুলে নিয়েছেন ফাইনালে। অন্যদিকে ১১ ম্যাচে মাহমুদ উল্লাহর দুটি করে ফিফটি আর অপরাজিত ইনিংসই বলে দেয় বরিশাল বুলসের ফাইনালে ওঠার পথে অধিনায়কোচিত ভূমিকাই রেখেছেন মাহমুদ উল্লাহ। ফর্মের কারণে জাতীয় দলের সহ-অধিনায়কত্ব হারানো এ ব্যাটসম্যানের নেতৃত্বগুণেরও যেন বিকাশ ঘটেছে টি-টোয়েন্টির এ আসরে। এলিমিনেটর ম্যাচে ১৩৫ রানকে পুঁজি করেও ঢাকা ডিনামাইটসকে আটকে দিয়েছেন মাহমুদ উল্লাহ আক্রমণাত্মক অধিনায়কত্ব দিয়েই। জনসম্মুখে মৃদুভাষী, অন্তর্মুখী তাঁর আত্মবিশ্বাসও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল একসময়। এবারের আসরে সেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসা মাহমুদ উল্লাহকে পেয়েছে বরিশাল বুলস।
একদিকে আজ ক্রিকেটে ‘জাতীয় নেতার’ মর্যাদা পেয়ে যাওয়া মাশরাফি, অন্যদিকে নেতৃত্বগুণে বিকশিত হওয়া মাহমুদ উল্লাহ। মাশরাফি নিজেও গুণমুগ্ধ অধিনায়ক মাহমুদ উল্লাহর, ‘দারুণ ক্যাপ্টেন্সি করছে রিয়াদ, খেলছেও ভালো।’ বিপিএলের জনস্রোতে দেখা গেছে তাঁদের দুজনের কুমিল্লা এবং বরিশালের সমর্থকগোষ্ঠী বেশ সরব। তবে নিশ্চিত করেই আগাম বলা যায় যে দর্শক সমর্থনের পাল্লাটা মাশরাফির কল্যাণে কুমিল্লার দিকে ঝুঁকে থাকবে আজও। তবে স্রেফ জনসমর্থন দিয়ে তো আর ট্রফি জেতা যায় না। ট্রফিটা উঠবে ব্যাটে-বলে আজকের সেরা দলের হাতেই।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শুরু হওয়া ফাইনাল শেষ হতে হতে রাত সাড়ে ১০টাও বাজতে পারে। ট্রফি উঠবে মাশরাফি কিংবা মাহমুদ উল্লাহর হাতে। এ অনিশ্চয়তা মিটে যাওয়ার পর কী ঘটবে, সেটি অবশ্য এখনই বলে দেওয়া যায়। কুমিল্লা যদি চ্যাম্পিয়ন হয় তাহলে ট্রফি উঁচিয়ে ধরা মাশরাফির ছবিটা কিংবদন্তি হয়ে থাকবে। আগের দুই বিপিএলের পর যে শিরোপার হ্যাটট্রিক হবে মাশরাফির। তবে একালে হ্যাটট্রিক করা লাগে না, তাঁর মাঝে যে কল্পনায় নিজের যোদ্ধা চেহারাটা কল্পনায় এঁকে নেন সবাই! ট্রফি হাতে মাহমুদ উল্লাহর হাস্যোজ্জ্বল ফ্রেমও প্রধান ছবি হবে কাল, যদি বরিশাল বুলস শিরোপা জেতে। কিন্তু ওটা গর্বিত মাশরাফির মতো ‘মনুমেন্ট’ হয়ে গেঁথে থাকবে না স্মৃতিতে। তাঁর বিশ্বকাপ কীর্তির মতো দ্রুতই ধূসরিত হয়ে যাবে এ ছবি।
এ ছবিটা বদলায়নি টেন্ডুলকার-দ্রাবিড়ের জীবনে। বদলাবে না মাশরাফি-মাহমুদ উল্লাহর দ্বৈরথেও। তবে ম্যাচ শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত কাপে অদৃশ্য হাত থাকবে দুজনেরই, টুর্নামেন্টের সেরা দুটি দলের দুই অধিনায়কের।
জিতবেন কে? একটা ট্রফি দিয়ে তো দুটি সেরা দল আর অধিনায়কের লড়াইয়ের নিষ্পত্তি হয় না মাশরাফির কাছে, ‘এমন দুটি দলের লড়াইয়ে হার-জিতে পার্থক্য নেই। দেখবেন খুব ভালো খেলা হবে।’ মাশরাফি যখন বলছেন, তখন ধরে নেওয়া যায় সেটা বিশ্বাসও করবেন সবাই!