এসবিএন ডেস্ক:
ভোটের আগেই এক দফা হয়ে গেল আওয়ামী লীগ-বিএনপি লড়াই। দুই দলের সমর্থক কাউন্সিলর প্রার্থীরা সবাই চান উটপাখি প্রতীক। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। শেষ পর্যন্ত লটারি হলো, জিতলেন বিএনপি সমর্থকরা। পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌরসভার পাঁচটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থীদের দুই পক্ষের মধ্যে এই লড়াইয়ে জেতার পর বিএনপি সমর্থকরা এটাকে তাঁদের জয়ের লক্ষণ হিসেবে দেখছেন।
আগামী ৩০ ডিসেম্বর ভোটের আগে গতকাল সোমবার নির্ধারিত দিনে প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে এমন কয়েকটি ছোটখাটো লড়াই হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। দলীয় মেয়র প্রার্থীদের প্রতীক পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল না, তাঁরা পাবেন তাঁদের দলীয় প্রতীক। কিন্তু স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা তাঁদের পছন্দের প্রতীক পাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। অনেক জায়গায় সমঝোতা হয়েছে, অনেক জায়গায় লটারি—শেষে অনেকের ভাগ্যে পছন্দের প্রতীক জুটেছে, অনেকের জোটেনি।
প্রতীক বরাদ্দের পরপরই প্রার্থীরা নেমেছেন আনুষ্ঠানিক প্রচারে। দ্রুত ছাপিয়ে কিছু পোস্টার গতকালই লাগিয়ে দিয়েছেন অনেকে। সব মিলিয়ে ভোটের আসল লড়াই গতকালই শুরু হলো। আর শুরুর দিনেই বরগুনায় পথসভায় ও জামালপুরে আওয়ামী লীগের নেতার বাড়িতে হামলা হয়েছে। চাঁদপুরে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে দুই মেয়র প্রার্থীকে জরিমানা করা হয়েছে। রাজশাহীতে সরকারদলীয় প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের খবর পাওয়া গেছে।
দেশের ৩২৩টি পৌরসভার মধ্যে ২৩৬টিতে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হচ্ছে ২৩৪টিতে। সীমানা জটিলতার কারণে বাগেরহাটের মংলায় নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে ভোট হবে আগামী ৭ জানুয়ারি।
এবারই প্রথম পৌরসভার মেয়র পদে নির্বাচন হচ্ছে দলীয়ভাবে। এর মধ্যে ভোটের লড়াই ছাড়াই আওয়ামী লীগের মোট ছয়জন নির্বাচিত হয়েছেন।
প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পর গতকাল বৈধ প্রার্থীদের চূড়ান্ত হিসাবটিও দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ২৩৪ পৌরসভায় মেয়র পদে মোট বৈধ প্রার্থী ৯২১ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৩৩ জন, বিএনপির ২১৯ জন ও জাতীয় পার্টির ৭৩ জন। মোট ৬৪৯ জন প্রার্থী দলীয়ভাবে লড়ছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা ২৭২ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শতাধিক ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী আছেন। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন অবৈধ ঘোষিত হওয়ায় জামায়াত দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে পারছে না। কিন্তু তাদেরও কিছু মেয়র পদপ্রার্থী আছেন, যাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন।
পৌরসভা নির্বাচনের মাধ্যমে সাত বছর পর ভোটের লড়াইয়ে মুখোমুখি হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এর আগে গত বছর ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনে মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ এলেও বিএনপি তাতে অংশ নেয়নি। এবার পৌর ভোট দলীয় প্রতীকে হওয়ায় দুই দলের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সুযোগ এসেছে।
ঢাকার বাইরের আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, দিনের প্রথম অংশে প্রার্থীরা প্রতীক পাওয়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তবে দ্বিতীয় ভাগে প্রচারণা ছিল তুঙ্গে। দিনশেষে শহরের প্রধান সড়কে পোস্টার সাঁটাতে শুরু করেছেন মেয়র ও কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরা। মাইকিং, প্রার্থীদের বাড়ি বাড়ি ভোট প্রার্থনা, উঠান বৈঠক, জনসংযোগ সবই শুরু হয়েছে জোরেশোরে।
ভোটারদের কাছে যেতে সবচেয়ে কম বেগ পেতে হবে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ পৌরসভায়। সেখানে ভোটার মাত্র ছয় হাজার ১০১ জন। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হবে বগুড়া সদর পৌরসভার প্রার্থীদের। কারণ সেখানে ভোটার দুই লাখ ৪৮ হাজার ৫৪ জন। তবে বেশির ভাগ পৌরসভায় ভোটারসংখ্যা গড়পড়তা ১৫ থেকে ২৫ হাজার। আগামী ২৮ ডিসেম্বর রাত ১২টার মধ্যে প্রচারণা বন্ধ করতে হবে প্রার্থীদের। অর্থাৎ পোস্টার, মাইকিং, জনসভা মিলিয়ে ভোটারের কাছে যেতে প্রার্থীরা সময় পাবেন ১৫ দিন।
হামলা, আচরণবিধি লঙ্ঘন : বরগুনায় আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী বর্তমান মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহাদাত হোসেনের পথসভায় হামলা চালিয়েছে দলটির মনোনীত প্রার্থীর কর্মীরা। এতে নারী ও শিশুসহ শাহাদাত হোসেনের অর্ধশতাধিক কর্মী ও সমর্থক আহত হয়। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইশতিয়াক হোসেন দিদারের বাসায় দলের ‘বিদ্রোহী’ মেয়র পদপ্রার্থীর সমর্থকরা হামলা চালিয়েছে।
বরগুনায় সন্ধ্যার পর সাড়ে ৭টার দিকে শহরের ক্রোক স্লুইস এলাকায় পথসভায় হামলার খবর পেয়ে শহরের কাঠপট্টি এলাকায় নৌকা প্রতীক ভাঙচুর করে বিদ্রোহী প্রার্থী শাহাদাত হোসেনের কর্মী ও সমর্থকরা। এ নিয়ে পশ্চিম বরগুনা এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ আওয়ামী লীগ প্রার্থী কামরুল আহসান মহারাজের এক কর্মীকে আটক করলেও অন্য কর্মীরা তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
এ বিষয়ে বরগুনা থানার ওসি রিয়াজ হোসেন বলেন, গণরোষের হাত থেকে বাঁচাতে পুলিশ শিমুল নামের ওই কর্মীকে আটকে রাখে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইশতিয়াক হোসেন দিদার জনান, স্বতন্ত্র মেয়র পদপ্রার্থী বর্তমান মেয়র শেখ মোহাম্মদ নুরুন্নবী অপুর সমর্থকরা তাঁর বাড়িতে হামলা চালিয়েছে। এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে তারা পালিয়ে যায়। পরে শহরে একটি প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ করে তাঁর সমর্থকরা।
আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী বর্তমান মেয়র নুরুন্নবী অপু পাল্টা অভিযোগ করেন, সকালে দিদার তাঁর প্রচারে বাধা দিয়েছিলেন।
এদিকে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ পৌরসভায় বিএনপি ও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মেয়র পদপ্রার্থীকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে জরিমানা করা হয়েছে। সন্ধ্যায় বিএনপির প্রার্থী হারুন আর রশিদ ফরিদগঞ্জ বাজারে ১৫-২০টি মোটরসাইকেল নিয়ে প্রচার চালান। তাত্ক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলাম ভূইয়া তাঁকে তিন হাজার টাকা জরিমানা করেন। কিছুক্ষণ পর ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের দেলোয়ার হোসেন একই বাজারে কর্মীদের নিয়ে মিছিল করেন। তাঁকে আচরণবিধি ভঙ্গের দায়ে তিন হাজার টাকা দণ্ড দেওয়া হয়।
রাজশাহীতে প্রতীক বরাদ্দের পরপরই নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে মোটরসাইকেল নিয়ে প্রচার চালাতে শুরু করেন সরকারদলীয় মেয়র পদপ্রার্থীরা। আড়ানী ও পুঠিয়া পৌরসভাসহ আরো কয়েকটি পৌরসভার আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে শোডাউন করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
আচরণবিধি লঙ্ঘন নিয়ে সতর্ক নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসি সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আচরণবিধি মেনে চলতে নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলোর কাছে, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের বিষয়ে সংসদ সচিবালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রার্থী ও ভোটাররা আচরণবিধি যেন অনুসরণ করেন, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ইতিমধ্যে তিন সংসদ সদস্য আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় শোকজ করা হয়েছে, তাঁরা জবাবও দিয়েছেন। আগামী দিনেও সবাই নিয়ম মেনে চলবেন এমন প্রত্যাশা সবার।
কোন দলে কত প্রার্থী : আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ছাড়া বাকি ১৭ দলের মধ্যে মেয়র পদপ্রার্থীর সংখ্যা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ৫৬, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ২০, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) ১৭, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ৭, জাতীয় পার্টির (জেপি) ৬, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ৪, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের ৩। এ ছাড়া বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পাটি (পিডিপি), ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, খেলাফত মজলিসের একজন করে প্রার্থী রয়েছে।
বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যেতে অনুমতি লাগবে মন্ত্রীদের : আচরণবিধি মেনে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যেতে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের অনুমতি নেওয়ার তাগিদ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় কোনো কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া যাবে না। তবে নির্বাচনী এলাকায় বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে মন্ত্রী-এমপিকে যেতে হলে ইসিকে জানাতে হবে। তাতে আমরা বাধা দেব না। যদি না জানিয়ে যান, তাতে বিধি লঙ্ঘিত হবে।’
উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত পৌরসভা নির্বাচনে অন্তত ৯ জন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ পেয়েছে ইসি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারদের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে ইসি সূত্র।
সিংগাইর পৌর নির্বাচন ৭ জানুয়ারি : কমিশনের সহকারী সচিব রাজীব আহসান বলেছেন, সিংগাইর পৌরসভার নির্বাচনের সময়সূচির পরিবর্তন আনা হয়েছে। বাছাই শেষে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় ২২ ডিসেম্বর এবং ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে। তবে তফসিল ঘোষণার পর যাঁরা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন, তাঁরা কেবল এ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী আওয়ামী লীগের মোট ছয়জন : প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় সাতটি পৌরসভায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ভোট ছাড়াই মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। পৌরসভাগুলো হলো পিরোজপুর, জামালপুরের মাদারগঞ্জ, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া, ফেনী সদর ও পরশুরাম, নোয়াখালীর চাটখিল। গতকাল সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসাররা এ ব্যাপারে গণবিজ্ঞপ্তি করেন।