বগুড়ার শিবগঞ্জে শিয়া মসজিদে গুলির ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে শিবগঞ্জ থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। এদিকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস বগুড়ার এ হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ।
তবে বগুড়ার পুলিশ বলছে, এ ঘটনায় কারা দায়ী তা এখনই বলার সময় আসেনি। তবে তারা নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবিকে সন্দেহ করছে। এ ঘটনায় চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শিবগঞ্জ উপজেলার চককানু গ্রামের ওই হামলায় মসজিদের (মসজিদ-ই-আল মোস্তফা) মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জেম হোসেন (৬৮) নিহত হন। গতকাল আসরের নামাজের পরে মসজিদের আঙিনাতেই তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর জানাজা ও দাফন অনুষ্ঠানে শত শত মানুষ অংশ নেন। চোখের পানিতে তাঁকে বিদায় জানান গ্রামবাসী, যার মধ্যে বেশির ভাগই সুন্নি। এর আগে বেলা তিনটার দিকে তাঁর লাশ গ্রামের বাড়ির পাশের মাঠে আনা হলে শত শত মানুষ ভিড় করেন। কান্নার রোল পড়ে যায় মানুষের মধ্যে। আশপাশের কয়েকটি জেলা থেকে আসা শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরাও জানাজা ও দাফনে অংশ নেন।
একই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন মসজিদের ইমাম শাহিনুর রহমান (৪২), মসজিদ কমিটির সভাপতি আবু তাহের (৬০) ও মুসল্লি এবং মসজিদের জমিদাতাদের একজন আফতাব হোসেন (৪৫)। কোমরে গুলিবিদ্ধ শাহিনুর রহমান ও পায়ে গুলিবিদ্ধ আবু তাহের বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে শাহিনুর রহমানের অবস্থা এখনো গুরুতর বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। পায়ে গুলিবিদ্ধ আফতাবকে বৃহস্পতিবার রাতেই হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার বিকেল পাঁচটায় হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের পোস্ট অপারেটিভ ইউনিটে ছিলেন শাহিনুর রহমান (৩৫)। তাঁর বোন তানজিলা বেগমের অভিযোগ, শরীরে গুলি নিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে হাসপাতালের শয্যায় যন্ত্রণায় কাতরালেও অস্ত্রোপচার করে গুলি বের করেননি চিকিৎসকেরা। অভিযোগের ব্যাপারে সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। সময়মতো অস্ত্রোপচার করা হবে।’
এদিকে ওই ঘটনায় মসজিদ কমিটির কোষাধ্যক্ষ সোনা মিয়া বাদী হয়ে শিবগঞ্জ থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন। মামলায় হত্যা, গুরুতর জখম ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে এশার নামাজের তৃতীয় রাকাতের সময় পেছন থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়। মসজিদে তখন ১৫ থেকে ১৬ জন মুসল্লি ছিলেন। তাঁদের অনেকে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। সবাই মেঝেতে লুটিয়ে পড়লে বন্দুকধারীরা দ্বিতীয় দফায় মসজিদের পিলারে এলোপাতাড়ি কয়েকটি গুলি করে সীমানা দেয়াল পার হয়ে চলে যায়।
ওই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ আফতাব আলী গতকাল তাঁর বাড়িতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাগরিবের নামাজ শ্যাষ। কেউ দোয়া পরিচ্চিলাম, কেউ এশার নামাজের প্রস্তুতি লিচ্চিলাম। হঠাৎ গুলির শব্দ। পিছনে ফিরে দেকি শুধু বিজলি আলোর ঝলকানি। গোটা মসজিদ ধোঁয়ায় অন্ধকার। সবাই চিত্কার করিচ্চে। কচ্চে, মরে গেলাম রে। কেউ মেঝেতে গড়াগড়ি যাচ্চে। রক্তে মেঝে ভেসে যাচ্চে। তখনো বুঝবার পারিনি হামার পাওত (পায়ে) গুলি লাগিচি। তারপর অজ্ঞান হয়্যা পড়ি।’
এ ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মসজিদ এলাকায় অবস্থান নিয়েছেন। গতকাল মসজিদ প্রাঙ্গণে কথা হয় পুলিশ ব্যুরো আব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আখতার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঘটনাস্থল থেকে তাঁরা আটটি গুলির খোসা সংগ্রহ করেছেন। গুলির খোসার সংখ্যা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা শুনে মনে হয়েছে, একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি করা হয়েছে।
গত ২৩ অক্টোবর রাজধানীর হোসেনি দালানে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি জমায়েতে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে দুজনকে হত্যা ও অন্তত দেড় শ জনকে আহত করা হয়। গত বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি এসব হামলা চালিয়েছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস এ ঘটনারও দায় স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে সাইট ইন্টেলিজেন্স। এ বিষয়ে বগুড়ার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওরা তো সবকিছুরই দায় স্বীকার করে ফেলছে। তবে আমরা এখনো কে দায়ী, সেটা বলার মতো পর্যায়ে যাইনি। তদন্ত চলছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুজনকে আটক করা হয়েছে।